Headlines
Loading...
সেন্টমার্টিনের অজানা রহস্যের গল্প

সেন্টমার্টিনের অজানা রহস্যের গল্প

বঙ্গোপসাগরের ছোট্ট একটি দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। এটিই বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। বাংলাদেশের সমুদ্র প্রেমীদের কাছে সেন্ট মার্টিন অত্যন্ত প্রিয়। কারণ বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে সেন্টমার্টিনের মত দ্বিতীয় কোন জায়গা নেই। সে কারণে বাংলাদেশের সেরা পর্যটন আকর্ষণ গুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে সেন্ট মার্টিন থাকবে সবার শীর্ষে। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বদিকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অবস্থান। সর্বপ্রথম কবে এই দ্বীপে মানুষের পদচারণা ঘটেছিল সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় 250 বছর আগে আরব বণিকদের নজরে আসে। আরব বণিকরা চট্টগ্রাম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করতে এসে এই দ্বীপে যাত্রাবিরতি করত। তারা এর নাম দিয়েছিল জাজিরা। আরবি ভাষায় অর্থ হল দীপ। পরবর্তীতে আশেপাশের অঞ্চলের মানুষের মুখে জাজিরা নামটি জিনজিরা নামে পরিবর্তিত হয়ে যায়। যতদূর জানা যায় 890 সালে বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের 13 টি পরিবার সেন্ট মার্টিন দ্বীপের স্থায়ী বসতি শুরু করে। তারা পেশা ছিল মূলত মৎস্যজীবী। সেসব পরিবারের বংশ পরম্পরায় সেন্টমারটিন বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়।

সেন্টমার্টিনের অজানা রহস্যের গল্প

শুরুর দিকে এই দ্বীপে শুধু ঝাউগাছ ছিল। এখানে নারকেল গাছ রোপণ করতে শুরু করে। সাগরের বুকে জেগে থাকা এমন একটি দ্বীপে। নারকেল গাছ খুবই কাজের। এই গাছ একইসাথে স্বাদুপানির কষ্ট লাঘব করে প্রখর রুদ্র ছায়া প্রদানসহ সামুদ্রিক ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে। এসব কারণেই তৎকালীন বাসিন্দারা বেশি বেশি নারকেল গাছ লাগাতে থাকে। একসময় পুরোটি নারকেল গাছ প্রধান দেশে পরিণত হয়। সে কারণেই স্থানীয় অধিবাসীরা নারিকেল-জিন্জিরা নামে ডাকতে শুরু করে। বর্তমানে প্রায় দেড় লাখেরও বেশি নারিকেল গাছ রয়েছে। সেন্টমার্টিনের আরেকটি জনপ্রিয় নাম দারুচিনি দ্বীপ। প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে তৌকির আহমেদ নির্মিত দারুচিনি দ্বীপ সিনেমার মাধ্যমে এই নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই উপন্যাস থেকে জানা যায় একসময় পর্তুগিজরা এই দ্বীপে এসেছিল তারা দ্বীপটির নাম দিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় লোকজন উচ্চারণ করতে পারত না তাই তারা বলতো দারুচিনি দ্বীপ। 1900 সালের দিকে ব্রিটিশ ভূমি জরিপ কারীরা এইদিকে ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। সেই জরিপে স্থানীয় নামের পরিবর্তে খ্রিস্টান সাধু মার্টিন এর নামানুসারে এর নাম লিখে।

সেন্ট মার্টিন পরবর্তীতে এই নামেই অধিক পরিচিত হয়। যদিও গবেষকরা মনে করেন দীপ্তিতে যেহেতু খ্রিস্টান জনসংখ্যা ছিল না। তাই সারাদিনের নামে নামকরণ এর বিষয়টি পুরোপুরি সঠিক নয়। তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মার্টিনের নামে জিৎ এর নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। টেকনাফ থেকে 9 কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমার উপকূল হতে 8 কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মাঝে নাফ নদীর মোহনায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অবস্থান। প্রশাসনিকভাবে দীপ্তি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার অধীনে থাকা একটি ইউনিয়নে ইউনিয়নে কয়টি গ্রাম আছে। ভৌগোলিকভাবে তিনটি অংশে বিভক্ত উত্তর অংশকে বলা হয় উত্তরপাড়া। দক্ষিণ অংশকে বলা হয় দক্ষিণপাড়া এবং সেন্টমার্টিনের একটি বিশেষ অংশ হলো ছেড়া দ্বীপ। বছর পর উত্তরপাড়া এবং পরবর্তী 100 বছরে দ্বীপের বাকি অংশ সমুদ্রের উপরে উঠে আসে। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের থাকা এই দ্বীপের দৈর্ঘ্য প্রায় আট কিলোমিটার। তবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পথে অনেক নাটকীয় পরিবর্তন দেখা যায়। দ্বীপের কোন অংশের প্রায় 700 মিটার আবার কোথাও মাত্র 200 মিটারে গিয়ে ঠেকেছে। ছোট্ট এই প্রবালদ্বীপের প্রকৃত আয়তন নির্ণয় করা টা একটু কঠিন। কারণ জোয়ার ভাটার সময় সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

ভাটার সময় সেন্টমার্টিনের সৈকত যথেষ্ট প্রশস্ত থাকলেও জোয়ারের সময় অধিকাংশ সৈকত সম্পূর্ণ পানিতে তলিয়ে যায়। সরকারি হিসাব মতে, এই দ্বীপের আয়তন  অনেক বর্গ কিলোমিটার। তবে বিভিন্ন কারণে দ্বীপের চারদিকে ভাঙ্গনের ফলে এই আয়তন কিছুটা কমে গেছে। সেন্ট মার্টিন উত্তর-দক্ষিণ বড় বড় হলেও দ্বীপটির পূর্ব পশ্চিম দক্ষিণ দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত প্রবাল পাথরের স্তূপ রয়েছে। সেন্টমার্টিনের ভূপ্রকৃতি প্রধানত সমতল প্রধান গঠন উপাদান হলো চুনাপাথর দ্বীপের উত্তরপাড়া এবং দক্ষিণপাড়া দুই অংশের মাঝখানে জলাভূমি রয়েছে। এসব জলাশয় মিঠা পানি সমৃদ্ধ এবং ফসল উৎপাদনের সহায়ক। তবে এখানে উৎপাদিত ফসল দ্বীপের চাহিদার তুলনায় খুবই নগণ্য। সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য নিঃসন্দেহে মুগ্ধ করার মত ভালো মত। ঘুরে দেখলে যে কেউ প্রেমে পড়তে বাধ্য। সেন্টমার্টিনের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের টানে বারবার এখানে ফিরে আসতে ইচ্ছে করবে। কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হলেও বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রের নীল জল দেখতে চাইলে আপনাকে সেন্টমার্টিনে আসতে হবে।

কক্সবাজার সৈকত থেকে সমুদ্রের পানির রং সাধারণ নদীর মতোই দেখায় কিন্তু সেন্টমার্টিনে থেকে আপনি যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই দেখা যাবে বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি। সেন্টমার্টিনের সৈকতে দাঁড়ালে আপনার মনে হবে, নীল আকাশ আর নীল জল সমুদ্র দিগন্তে গিয়ে মিশে গেছে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে দ্বীপের পূর্ব পশ্চিম দিকের সৈকত থেকে টেকনাফ আর মিয়ানমারের পাহাড় চোখে পড়বে নারিকেল জিঞ্জিরায় বেশ কয়েকটি সৈকত রয়েছে। প্রতিটি সৈকত যেন ভিন্ন ভিন্ন আমেজে তার রূপের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। অধিকাংশ সৈকতেই রয়েছে অসংখ্য প্রবাল দ্বীপের বিভিন্ন প্রান্তের সৈকত আপনাকে সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা দিকে। দারুচিনি দ্বীপ থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত খুব ভালোভাবে উপভোগ করা যায়। দ্বীপের অসাধারণ প্রকৃতি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের যেনো খানিকটা ভিন্ন রূপে ধরা দেয়। 1996 সালের দিকে, প্রতিবছর সেন্টমার্টিনে পর্যটক মাত্র দেড়শ থেকে দুইশ জন আর বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখেরও বেশি লোক এই দ্বীপে ভ্রমণ করে। মাত্র দুই দশকেরও কম সময়ে সেন্টমারটিন বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। সে কারণে সেন্টমার্টিনে হোটেল রিসোর্ট গড়ে উঠেছে।

2012 সালে মাত্র 17 টি হোটেল ছিল আর বর্তমানে হোটেল-মোটেল ও কলেজের সংখ্যা 124 টি। সেন্টমার্টিনের পশ্চিমবঙ্গের প্রধান শরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এ দিকটাতেই দ্বীপের সবচেয়ে দীর্ঘ অবিচ্ছিন্ন সৈকত রয়েছে। একটু নিরিবিলি থাকতে চাইলে পশ্চিম বিষয়গুলো খুবই ভালো। কারণ এদিকের অধিকাংশ রিসোর্ট থেকেই সরাসরি সাগর দেখা যায়। সমুদ্র উপভোগ করার জন্য কষ্ট করে যাওয়ার দরকার পড়েনা। সেন্টমার্টিনের পশ্চিম বিচে লেখক হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি আছে। বাড়ির নাম সমুদ্র বিলাস। এটিও সেন্টমার্টিনের একটি জনপ্রিয় জায়গা। হুমায়ূন আহমেদের দারুচিনি দ্বীপ উপন্যাস এবং চলচ্চিত্র এই দ্বীপের পর্যটন প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের একটি বিশেষ জায়গার নাম গলাচিপা। এই অংশে সবচেয়ে সংকীর্ণ গলাচিপার মাছ বরাবর দাঁড়ালে উভয় দিকেই সাগর দেখা যায়। সাইকেল ভাড়া করে নিজে নিজে ঘুরে দেখতে পারেন। সেন্টমার্টিনের পুরো এলাকা ইদানিং এখানে মোটরসাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। বাংলাদেশের যেকোন প্রান্ত থেকে সেন্ট মার্টিন যেতে হলে আপনাকে প্রথমে আসতে হবে কক্সবাজার অথবা টেকনাফ।

নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়টা সেন্টমার্টিনের প্রধান পর্যটন মৌসুম। কারণে সময় সাগর বেশ শান্ত থাকে। পর্যটন মৌসুমে টেকনাফ থেকে বেশ কয়েকটি জাহাজ এবং সি-ট্রাক সেন্টমার্টিনে পর্যটক পরিবহন করে। এছাড়া বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের টেকনাফ থেকে সারাবছর ট্রলারে করে সেন্ট মার্টিন যাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজার থেকে সরাসরি সেন্টমার্টিন যাওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর ঘাট থেকে জাহাজ সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে যাত্রা করে। কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনের দূরত্ব প্রায় 120 কিলোমিটার। এখান থেকে জাহাজ ঘন্টায় 12 নটিক্যাল মাইল বেগে ছুটে চলে। এক নটিক্যাল মাইল সমান 1 .85 কিলোমিটার। সাধারণত কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন যেতে 5 থেকে 6 ঘন্টা সময় লাগে। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেন্টমার্টিনে পৌঁছা সম্ভব হয়না। জোয়ার-ভাটা এবং আবহাওয়ার প্রভাবে কখনো কখনো 7 ঘন্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। বঙ্গোপসাগরে চলতে চলতে দূরে সাগরের বুকে এক চিলতে ভূমি চোখে পড়বে। সেন্ট মার্টিন একদিকে গভীর সাগর আর অন্যদিকে মিয়ানমারের পাহাড়ের সারি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জেটিঘাটে পৌঁছানোর পরে মন যেন আরও অস্থির হয়ে ওঠে। এত বড় নৌযানের হাতেই প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লেগে যায়।

দ্বীপের শিশু-কিশোররা জাহাজঘাটা ফিরাতে সাহায্য করে দীর্ঘ সমুদ্র সফরের ক্লান্তি ঘোচাতে দিবেন। আমার অপেক্ষা অনেকেই আবার সে দিনই ফিরে আসবে যারা সকালে গিয়ে বিকেলে চলে আসে। তারা আসলে এই দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে না। কারণ তারা অসাধারণ সুন্দর এই দ্বীপের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে থাকা সৌন্দর্য উপভোগের জন্য সর্বোচ্চ মাত্র তিন ঘন্টা সময় পায় দারুচিনি দ্বীপে। বেড়ানোর জন্য তা নিতান্তই সামান্য সময়। কারণ মাত্র তিন ঘন্টায় বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর এই সামুদ্রিক ঘুরে দেখা অসম্ভব। তাই এখানে কমপক্ষে একদিন থাকলে সেন্টমার্টিন ভ্রমনের প্রতি সুবিচার করা হয়। পর্যটন মৌসুমে সেন্টমার্টিনে প্রচুর দর্শনার্থী চাপে দিবে। আপনার অবস্থান এর অভিজ্ঞতা আনন্দঘন নাও হতে পারে। কারণ এই দ্বীপে নির্জনে বসে প্রকৃতির সাথে বোঝাপড়া করার মতো বহু জায়গা আছে। লোকজনের ভিড় থাকলে সেরকম কোন জায়গায় টাকা পাবেন না। সেজন্য অনেকে পর্যটন মৌসুম শুরু হবার আগে আগে সেন্টমার্টিনদ্বীপে ঘুরে যেতে চাই। এমন মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে কোলাহল সত্যিই বেমানান।

সেন্টমার্টিনের জেটিঘাট বাজার ছাড়া সেই অর্থে তেমন দোকানপাট নেই। বিচারে কিছু দোকান অবশ্য আছে, তবে সেগুলোতে খুব কম পাওয়া যায়। একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সেন্টমারটিন বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্গম জায়গা গুলোর একটি। পর্যটন মৌসুমে এখানে বেশ কয়েকটি জাহাজ চলে ঠিকই কিন্তু এগুলো রসদ সরবরাহের কোনো কাজে আসে না। সেন্টমার্টিনের প্রয়োজনীয় সকল মালামাল এধরনের ট্রলারে করে টেকনাফ থেকে নিয়ে আসা হয়। সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন যে বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যতিক্রম ইউনিয়ন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে জেগে থাকলেও বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রামের সাথে অনেক মিল আছে। শুধু সৈকত ধরে ঘুরে বেড়ালে নারিকেল জিঞ্জিরার অনেক কিছুই আপনার অজানা থেকে যাবে। দ্বীপের মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে হলে ভেতরের গ্রামগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। এই দ্বীপের ভেতরের রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে আপনার মনে হবে যেন সাগরের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশে। এই বাংলাদেশের নেই শুধু ঘনবসতি। বাংলার সকল বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে অপরূপ প্রকৃতি আর শান্তির এক অন্যরকম বাংলাদেশ।

নারিকেল জিঞ্জিরায় প্রায় 10 হাজার মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করে পর্যটকদের প্রতি দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দাদের ব্যবহার অত্যন্ত আন্তরিক। তাদের সহজ সরল জীবনযাপন আপনাকে মুগ্ধ করবে। এই দ্বীপের মানুষ অত্যন্ত ধর্মপরায়ন। পর্যটকেরা এখানে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারে। নারিকেল জিঞ্জিরার অধিকাংশ মানুষ মৎস্যজীবী। দ্বীপের চারদিকের সৈকতের দিনে-রাতে জেলেদের কর্মকাণ্ড চোখে পড়বে। জেলেরা দিনের বেলায় জাল মেরামত করে আর রাতের বেলায় মাছ ধরে। সমুদ্রে মাছ ধরা যে কত কঠিন কাজ তাদের কর্ম ব্যস্ত সময় পার করতে দেখলে তার সহজেই বোঝা যায়। সাধারণত দুপুর বিকাল থেকে জেলেরা তাদের নৌকা নিয়ে সাগরের গভীরে রওনা হয়। মাছ ধরা শেষে আবার মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত তারা দিকে ফিরে আসতে থাকে। জেলেরা রাতের বেলা সাগর থেকে মাছ ধরার পর কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় তাদের নৌকা ভিড়াই। এগুলোকে ফিশারীঘাট বলে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এর প্রায় 20 থেকে 25 ফিশারীঘাট রয়েছে। এসব আরতে মাছ গুলো আলাদা করে ওজন করার পর চলে যায় পাইকারদের হাতে। এখানে মাছের দাম খুবই সস্তা। সাধারণ বাজারমূল্যের অর্ধেক দামে মাছ পাওয়া যায়।

সরাসরি সাগর থেকে আসার  মাছের চেয়ে সহজ সামুদ্রিক মাছ আপনি অন্য কোথাও পাবেন না। সেন্টমার্টিনের একাধারে সুস্বাদু এবং মিষ্টি। তবে ইদানিং এত বিপুল পর্যটক এখানে আসে যে মৌসুমের শুরুতেই শেষ হয়ে যায়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মতো একটি অংশ হলো ছেঁড়াদ্বীপ। জোয়ারের সময় ছেড়া দ্বীপ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সে কারণেই জায়গাটির নাম হয়ে গেছে। তবে ভাটার সময় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জেগে উঠলে পায়ে হেঁটেই ছেড়া দ্বীপে যাওয়া যায়। জোয়ারে এই অংশটি কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই জোয়ারের সময় ছেঁড়াদ্বীপে ভ্রমণ করার সম্পূর্ণ নিষেধ। মাত্র কয়েক বছর আগেও ছেড়াদ্বীপ যাবার প্রধান বাহন ছিল স্পীডবোট। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ পর্যটক সাইকেল বা মোটরসাইকেল এই ছেঁড়া দ্বীপে ঘুরতে যাই। ছেড়াদ্বীপ আবার তিনটের সময় গঠিত। 

  • প্রথম দ্বীপটির নাম নিঝুম দ্বীপ।
  • দ্বিতীয় টি হল আসল ছেড়াদ্বীপ
  • সবশেষে রয়েছে প্রবালদ্বীপ।

ছেঁড়াদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত প্রবালদ্বীপে বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের ভূখণ্ড। এরপরে বাংলাদেশের আর কোন ভূমি নেই। 2018 সালের 6 অক্টোবর মিয়ানমার সরকার তাদের জনসংখ্যা বিষয়ক একটি মানচিত্রে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ মিয়ানমারের অংশ হিসেবে তুলে ধরে। সেই মানচিত্র দুটি আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ঢাকায় নিযুক্ত ম্যানমার রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরবর্তীতে মিয়ানমার তাদের ভুল স্বীকার করে নেয়। 1900 সালে বার্মা এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকলেও সেন্ট মার্টিন দ্বীপ যখন বার্মার ভেতরে না দিয়ে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সেই থেকে ঘটনাক্রমে সেন্টমারটিন বাংলাদেশের মালিকানা এসেছে। অতীতেও বেশ কয়েকবার বার্মিজ Navy-বাংলাদেশ জেলেদের ওপর অন্যায় ভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে। এ ধরনের অনিশ্চিত আক্রমণ প্রতিহত করতে এবং দ্বীপের নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী এবং কোস্টগার্ডের দুটি যুদ্ধজাহাজ সেন্টমার্টিনের জলসীমায় সব সময় নিয়োজিত থাকে। এছাড়া দ্বীপের জাহাজ ঘাটের পাশে বাংলাদেশ নৌবাহিনী কোস্টগার্ড আনসার এবং পুলিশের ঘাঁটি রয়েছে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন শুরু হবার প্রথমদিকে কিছু রোহিঙ্গা জনগণ সেন্টমার্টিনে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন স্থানীয় লোকজন তাদের সাদরে গ্রহণ করেছিল। পরবর্তীতে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী তাদেরকে টেকনাফের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই দ্বীপের চারদিকে প্রায় 1.32 বর্গকিলোমিটার প্রবাল আচ্ছাদন ছিল। বর্তমানে রয়েছে মাত্র 0.39 বর্গ কিলোমিটার। দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ এ 40 বছরের ব্যবধানে তিনভাগের একভাগ প্রবাল নেই। গবেষকরা মনে করেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে 2045 সালের মধ্যে সেন্টমারটিন সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। প্রবাল ছাড়াও এই দ্বীপে 187 প্রজাতির শামুক, 153 প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, 157 প্রজাতির গুপ্ত জীবি উদ্ভিদ, 240 প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর, 120 প্রজাতির পাখির প্রজাতি স্তন্যপায়ী এবং বেশ কয়েক জাতের অমেরুদন্ডী প্রাণী রয়েছে। এছাড়া একাধিক প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার জন্য সেন্টমারটিন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই দ্বীপের নারিকেল ইত্যাদি গাছ রয়েছে। তবে প্রাকৃতিক বলতে যা বোঝায় তেমন কোন অঞ্চল নেই। দ্বীপের দক্ষিণ দিকে প্রচুর পরিমাণে এবং বেশ কিছু ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ রয়েছে।

বিপুল পরিমাণ পর্যটকদের চাপে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। প্রতিদিন জনসংখ্যার চেয়েও বেশি সংখ্যক পর্যটক এই দ্বীপে বেড়াতে যায়। তাদের অবস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে গিয়ে অবাধে বৃক্ষনিধন সহ প্রকৃতির ক্ষতি করা হচ্ছে। 40 বছর আগে দিবে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা ছিল। সাড়ে 4 বর্গ কিলোমিটার আর বর্তমানে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মাত্র তিন বর্গকিলোমিটার। এরকম পর্যটকেরা যে পরিমাণ বর্জ্য ফেলে যায় তার অধিকাংশ সরাসরি সাগরে গিয়ে পড়ে। ফলে দ্বীপের আশেপাশের সাগর চরম মাত্রায় দূষিত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের গড় উচ্চতা মাত্র সাড়ে তিন মিটার যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাতে আগামী 100 বছরের মধ্যে এই দ্বীপটির সম্পূর্ণ পানিতে তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এসব কারণে অনলাইন নিবন্ধন এর মাধ্যমে সেন্টমার্টিনের সীমিত সংখ্যক পর্যটক যাতায়াতে নিশ্চিত করা এবং পর্যটকদের দ্বীপে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে একটি সরকারি সিদ্ধান্তের কথা শোনা যাচ্ছিল।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার এসব সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে বলে সেন্টমার্টিনে পর্যটক সীমিতকরণ এবং রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করা হলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের দাবি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে উদ্যোক্তার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। স্থানীয় বাসিন্দারা জীবিকা হারাবে এবং পর্যটন খাতের প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। পর্যটক এর অধিক চাপে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ তার সৌন্দর্য হারাতে বসেছে ঠিকই। কিন্তু বাংলাদেশে একেতো ঘোরাঘুরি মতো সেরা জায়গার অভাব রয়েছে। তারপর যদি সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে পর্যটকদের বঞ্চিত করা হয়। তাহলে তা দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য বিরাট লোকসানের বিষয়। সেজন্য পর্যটন শিল্প এবং সেন্টমারটিন উভয়কে বাঁচাতে হলে টেকসই পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দ্বীপে ভ্রমণ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বসবাস পরিবেশবান্ধব উপায় ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জীববৈচিত্র্য সেন্টমার্টিনের অপরূপ সৌন্দর্যের রক্ষনাবেক্ষনের প্রতি যত্নশীল হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সেন্টমার্টিনে ঘুরতে আসা পর্যটকদের প্রতি অনুরোধ হলো যেহেতু দীপ্তি বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ তাই এখানে বেড়াতে গেলে এর প্রকৃতির কোন ক্ষতি করবেন না।

রাতের বেলা সেন্টমার্টিনের সৈকতে আলো বা আগুন জালানো এবং আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানো সম্পূর্ণ নিষেধ। দ্বীপের যেখানে সেখানে খাবারের প্যাকেট প্লাস্টিকের বোতল বা ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না। মনে রাখবেন আপনার সামান্য অসচেতনতার জন্য অপচনশীল আবর্জনা সমুদ্র থেকে যাবে কয়েক হাজার বছর। সারা বিশ্বের মানুষ এত পরিমান প্লাস্টিক আবর্জনা নিক্ষেপ করেছে যে আগামী কয়েক বছর পরে সমুদ্রে মাছ এর চেয়ে প্লাস্টিকের সংখ্যা বেশি থাকবে। এছাড়া সেন্টমার্টিনের প্রবাল শামুক-ঝিনুকের বাণিজ্য আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই এগুলো না কেনার জন্য পর্যটকদের উৎসাহিত করা হয়।  পরিশেষে বলতে চাই বাংলাদেশের আরেকটি অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ  হল সেন্টমার্টিন দ্বীপ।এখানে সকলকে ঘুরে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই।