পদ্মা সেতু নির্মাণে যা যা ঘটেছিল

এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়িত হওয়া দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প ধরা হয় পদ্মা সেতুকে। কিন্তু এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে এটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প। কারণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বাজেট ধরা হয়েছে 1 লক্ষ 13 হাজার কোটি টাকা। যেখানে পদ্মা সেতুর বাজেট ছিল 30 হাজার কোটি টাকা। তারমানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যত টাকা খরচ হবে তা দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু বানানো যাবে। বাংলাদেশের প্রথম  "শক্তি কর্পোরেশন" রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে 2 হাজার 400 মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র সাম্প্রতিক সময়ে নির্মাণ করা হলেও এর পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। 1961 সালে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরপর 1962 থেকে হাজার 1968 সালের মধ্যে বর্তমান প্রকল্প অঞ্চলকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। সেই সময়ের মধ্যে এই প্রকল্পের জন্য 260 একর জমি ও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট আবাসিক এলাকার জন্য 32 একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। তখন ভূমি উন্নয়ন রেস্টহাউজ বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন এবং কিছু আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু 1969 সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রূপপুরে প্রকল্প বাতিল করে প্রকল্পটিকে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যায়।

পদ্মা সেতু নির্মাণে যা যা ঘটেছিল

তারপর দেশ স্বাধীন হাজার 1972 থেকে 1974 সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। 1975 সালে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে সেই প্রকল্প টি বন্ধ হয়ে যায়। 1977 সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সংক্রান্ত আরেকটি প্রকল্পের কাজে যায় কিন্তু অর্থের যোগান না থাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। 1986 সালে জার্মানির সাথে যৌথ উদ্যোগে আর একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা 1987 থেকে 1988 সালের মধ্যে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ড এর দুটি কোম্পানি আরেকটি সম্ভাব্যতা যাচাই পরীক্ষা করে 500 মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করে। তখনও নানা কারণে প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়।1996 সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ডঃ ওয়াজেদ মিয়া তিনি 2000 সাল পর্যন্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অনেক চেষ্টা করেন। 2008 আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে 2009 সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশিয়ান এটমিক এনার্জি কর্পোরেশন এর মধ্যে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার বিষয়ক চুক্তি হয়। 2010 সালে জাতীয় সংসদের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। 2011 সালে বাংলাদেশে রাশিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে 2013 সালে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজের উদ্বোধন করেন।এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ 12 বছর ধরে ঝুলে থাকা এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। মহামারীর মধ্যেও এই প্রকল্পে 25 হাজার শ্রমিক দিনরাত কাজ করেছে কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে। 2023 সালে প্রথম ইউনিট এবং 2024 সালের মধ্যে রূপপুরের দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা যাবে। এরপর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি 60 বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আরো একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লার মজুদ খুবই সীমিত। অন্যদিকে জ্বালানি তেল আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে। বর্তমানে এই বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে দেশের মোট বিদ্যুৎ এর 10% পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে পারমাণবিক শক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। পরিবেশ বান্ধব এবং জীবাশ্ম জ্বালানি সাশ্রয় বিকল্প এই প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হয়না। সেই সাথে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক উৎপাদন করে না। ফলে অ্যাসিড বৃষ্টি বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা নেই। সে দিক থেকে পারমাণবিক কমপক্ষে 10 লক্ষ গুণ বেশি।

সেজন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মাত্র একজন ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে 2000 কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে কয়েক টন কয়লা প্রয়োজন তাছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ প্রচলিত অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় অনেক কম। যদিও এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলতে প্রাথমিকভাবে বহু টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। তবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দীর্ঘমেয়াদে পরিচালনা করতে পারলে বিদ্যুতের দাম বেশ সস্তা হয়ে আসে। বর্তমানে সারাবিশ্বে 31 টি দেশে 449 পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সমগ্র পৃথিবীর মোট বিদ্যুতের 14% উদ্ভাবিত হয় এসব পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। এছাড়াও বর্তমানে 14 টি দেশে 68 নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। 2025 সালের মধ্যে আরও 27 টি দেশের 173 পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে 30 টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এমন দেশে নির্মিত হবে যারা আগে কখনো পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করেনি। বাংলাদেশে এরকম দেশের মধ্যে একটি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে।

দেশটিতে মোট নিরানব্বইটি পারমাণবিক চুল্লি আছে এর পরেই রয়েছে ফ্রান্স জাপান চীন এবং রাশিয়া 58 টি। জাপানের 42-37 এবং রাশিয়ার 35 আণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। এছাড়া আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বর্তমানে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুরি রয়েছে এবং আরও ছয়টি নির্মাণাধীন আছে। এর বাইরে আরও 24 পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিকল্পনাধীন রয়েছে। বর্তমান বিশ্বে একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন থাকাতে জীবাশ্ম জ্বালানীর বিকল্প হিসেবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ যেমন জনপ্রিয় হচ্ছে বিপরীতে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ভয়াবহতা চিন্তা করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসার প্রবণতা বাড়ছে। এখনো পর্যন্ত বিশ্বের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোতে 57 টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা সামান্য অসঙ্গতি থেকে ভয়াবহ দুর্ঘটনা পর্যন্ত সাতটি ভাগে ভাগ করেছেন। তবে তিনি বিপর্যয় কে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হল 1986 সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পারমাণবিক বিপর্যয় এবং সর্বশেষ বিপর্যয় ঘটেছিল 2000 সালে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এটি সঠিকভাবে পরিচালনা করা। ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট এবং ইমারজেন্সি রেসপন্স এর জন্য অত্যন্ত দক্ষ জনবল প্রয়োজন। এমনকি যারা পরিচালনা পর্ষদে থাকবে তাদের এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে হবে। বাংলাদেশের সর্বকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই প্রকল্পে 21 বছর আগে নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ভবনে ফ্ল্যাট গুলোর জন্য মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় 6000 টাকা। এছাড়া একটি বালিশ নিচ থেকে উপরে তোলার জন্য 760 টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এর প্রতিবাদে অনেকেই বিক্ষোভ করে। বিষয়টিকে ইতিহাসের সেরা লুডু বলে আখ্যায়িত করেছে। বর্তমানে জ্বালানির অভাব এ দেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। ফলে সারাদেশের লোডশেডিং এর পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি তেলের উপর নির্ভরশীলতা অনেক কমে আসবে। তখন দেশের মানুষ লোডশেডিং এর হাত থেকে রেহাই পাবে।

Previous Post Next Post