ভারতে মুসলিমদের উপর নিপীড়ন: কারণ ও বিশ্লেষণ

ভারত, একটি বহু-ধর্মীয় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ২০০ মিলিয়ন মুসলিম জনগোষ্ঠী ভারতের সংখ্যালঘু হলেও, তাদের উপর হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এবং কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানাবিধ নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এই আর্টিকেলে আমরা ভারতে মুসলিমদের উপর নিপীড়নের কারণ, এর ধরন এবং এর বিশ্লেষণ করব।

ভারতে মুসলিমদের উপর নিপীড়ন: কারণ ও বিশ্লেষণ

১. নিপীড়নের ধরন

ক. শারীরিক নির্যাতন ও হত্যা

মুসলিমদের উপর শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ভারতে ক্রমশ সাধারণ হয়ে উঠেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী জনতা কর্তৃক মব লিঞ্চিং (গণপিটুনি) একটি প্রধান সমস্যা। উদাহরণস্বরূপ, গরু হত্যা বা গরুর মাংস ব্যবসার সন্দেহে মুসলিমদের লক্ষ্য করে হামলা করা হয়, কারণ গরু হিন্দুদের কাছে পবিত্র। ২০১৯ সালে ঝাড়খন্ডে তাবরেজ আনসারি নামে এক মুসলিম ব্যক্তিকে হিন্দু জনতা নির্যাতন করে হত্যা করে এবং তাকে জোর করে হিন্দু ধর্মীয় স্লোগান আওড়াতে বাধ্য করে। এছাড়াও, ২০২৩ সালে নুহ সংঘর্ষে ৭ জনের মৃত্যু এবং ৭০ জনের আহত হওয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

খ. পুলিশি নির্যাতন ও বেআইনি আটক

পুলিশের পক্ষ থেকেও মুসলিমদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। উত্তর প্রদেশে ২০২০ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) বিরোধী বিক্ষোভের সময় পুলিশ বেআইনিভাবে শতাধিক মুসলিমকে আটক করে, তাদের উপর নির্যাতন করে এবং জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করে। ২০২২ সালে গুজরাটের খেদা জেলায় পুলিশ প্রকাশ্যে মুসলিম পুরুষদের লাঠি দিয়ে প্রহার করে, যা ভিডিওতে ধরা পড়ে এবং সমালোচনার মুখে পড়ে।

গ. সম্পত্তি ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুতি

বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে মুসলিমদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যাকে সমালোচকরা "বুলডোজার জাস্টিস" হিসেবে অভিহিত করেছেন। ২০২২ সালে মধ্যপ্রদেশের খারগোনে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পর কর্তৃপক্ষ ১৬টি বাড়ি এবং ২৯টি দোকান ধ্বংস করে, যার অধিকাংশই মুসলিমদের মালিকানাধীন ছিল। এই ধরনের পদক্ষেপ আইনি প্রক্রিয়া বা পূর্ব নোটিশ ছাড়াই করা হয়, যা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির সমতুল্য।

ঘ. সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য

মুসলিমরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় প্রবেশে বৈষম্যের শিকার। ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতের মুসলিমদের মধ্যে সাক্ষরতার হার মাত্র ৭৭.৭%, এবং তারা প্রায়শই নিম্ন-আয়ের কাজে নিয়োজিত থাকে। এছাড়াও, ৭৯% মুসলিম ভারতীয় আরও সহিংসতা এবং সরকারি নিপীড়নের ভয়ে বাস করে, যা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে।

২. নিপীড়নের কারণ

ক. হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক এজেন্ডা

২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটেছে। বিজেপি এবং এর সহযোগী সংগঠন যেমন আরএসএস, বিএইচপি এবং বজরং দল ভারতকে একটি "হিন্দু রাষ্ট্র" হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। এই আদর্শ মুসলিমদের "বহিরাগত" বা "অনুপ্রবেশকারী" হিসেবে চিহ্নিত করে, যা তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উস্কে দেয়। ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC) এর মতো আইন মুসলিমদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার আশঙ্কা তৈরি করেছে।

খ. ঐতিহাসিক শত্রুতা ও বিভাজন নীতি

ভারতের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে ইসলামিক শাসন এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের স্মৃতি এখনও জনমানসে রয়ে গেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে "বিভাজন ও শাসন" নীতির মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছিল, যার প্রভাব আজও দৃশ্যমান। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা প্রায়শই এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে ব্যবহার করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে।

গ. ঘৃণামূলক বক্তব্য ও প্রচারণা

বিজেপি নেতা এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর ঘৃণামূলক বক্তব্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উৎসাহিত করে। ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে হিন্দুত্ব ওয়াচ নামক একটি সংস্থা ২৫৫টি ঘৃণামূলক বক্তব্য ও সহিংসতার ঘটনা রেকর্ড করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একজন হিন্দু সাংসদ প্রকাশ্যে একজন মুসলিম সাংসদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননাকর মন্তব্য করেন।

ঘ. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাত

পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার মধ্যে পক্ষপাত মুসলিমদের নির্যাতনের একটি বড় কারণ। ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পুলিশের অর্ধেক সদস্য মুসলিম-বিরোধী পক্ষপাত প্রদর্শন করে, যার ফলে তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অপরাধে হস্তক্ষেপ করতে অনীহা দেখায়। এছাড়াও, মুসলিমদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের এবং আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার সাধারণ হয়ে উঠেছে।

৩. বিশ্লেষণ

ক. রাজনৈতিক সুবিধা ও ভোটের রাজনীতি

হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা বিজেপির জন্য রাজনৈতিক সুবিধা এনে দিয়েছে। মুসলিমদের "অন্য" হিসেবে চিহ্নিত করে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোট একত্রিত করা তাদের কৌশলের অংশ। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি তাদের প্রচারণায় হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দিয়ে ভোটের শতকরা ৭ ভাগ বৃদ্ধি পায়। এই কৌশল মুসলিমদের প্রান্তিক করে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার লক্ষ্যে কাজ করে।

খ. সামাজিক বিভাজন ও ভয়ের পরিবেশ

মুসলিমদের উপর নিপীড়ন ভারতের সামাজিক ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় ও অসুরক্ষার অনুভূতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করছে। এই পরিস্থিতি হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তুলছে এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

গ. আন্তর্জাতিক প্রভাব

ভারতে মুসলিম নিপীড়ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। জাতিসংঘ এবং ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (USCIRF) ভারতকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিপীড়নের জন্য সমালোচনা করেছে এবং ভারতকে "কান্ট্রি অব পার্টিকুলার কনসার্ন" হিসেবে চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছে। তবে, ভারত ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন বা ১৯৬৭ সালের প্রটোকলের স্বাক্ষরকারী নয়, তাই আন্তর্জাতিক আইনি চাপ সীমিত।

ভারতে মুসলিমদের উপর নিপীড়ন একটি জটিল সমস্যা, যার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থ, ঐতিহাসিক শত্রুতা এবং সামাজিক পক্ষপাত। বিজেপি সরকারের হিন্দু জাতীয়তাবাদী নীতি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাত এই নিপীড়নকে তীব্র করেছে। এই পরিস্থিতি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রের জন্য হুমকি এবং দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সমাধানের জন্য প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপের উদ্যোগ।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post